- আমাদের দাওয়াত :
হিল্লা বিয়ে ইসলাম বিরোধী ও নারীর প্রতি বৈষম্ (সংগৃহীত)
হিল্লা বিয়ে কি?
আভিধানিকভাবে হিল্লা
বলতে উপায়, গতি, ব্যবস্থা, আশ্রয়
ও অবলম্বন বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন-
তোমার কি কোন হিল্লা
(গতি বা উপায়) হয়েছে?
বা মেয়েটির কোন হিল্লা বা আশ্রয় হয়েছে? কিন্তু
প্রচলিত পরিভাষায় হিল্লা বলতে, কোন স্বামীর তিন তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে
এ শর্তে বিয়ে করা যে, বিয়ের
পর সহবাস শেষে স্ত্রীকে তালাক দেবে, যেন সে পূর্বের স্বামীর জন্য হালাল হয়, সে
তাকে পুনরায় বিয়ে করতে পারে।
এই হিল্লা বিয়ে শুধু
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আর
ভারতে নয়, পৃথিবীর
সব মুসলিম অধ্যুষিত দেশেই কম-বেশী প্রচলিত আছে।
আরবে এই হিল্লা বিয়েকে হাল্লালা বলে।
হিল্লা শব্দটি আরবী (حلة) ‘হালা’ থেকে এসেছে।
এর অর্থ বৈধতা/বৈধকরণ।
যদিও আরবী হালাল শব্দের অর্থ
হলো ইসলামে অনুমোদনপ্রাপ্ত। কিন্তু
হিল্লা বিয়ে মোটেই হালাল নয়।
হিল্লা বিবাহ হারাম
এবং তা মূলত কোনো
বিয়েই নয় বরং হিল্লা স্বামীর সাথে বিয়ে ও সহবাস হারাম।
সে যাই হোক এখন প্রশ্ন হলো, তালাকের
পরে আপন স্ত্রী যদি পর নারী হয়েই যায় তবে তাকে আবার বিয়ে
করা বৈধ হওয়া উচিৎ। কেননা
আপন ভগ্নী, খালা-ফুফু
ইত্যাদি ছাড়া অন্য কাউকে বিবাহ করা জায়েজ।
সে তো তখন ঐ গোত্রেই পরে।
• প্রসঙ্গ বাংলাদেশ •
হিল্লা বিয়ে জানেন
না এমন বাংলাদেশী হয়ত একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বাংলায় এটা কোনকালেই ছিল না কিন্তু এখন গত পনেরো
বিশ বছর ধরে এটা খবরের কাগজে প্রায়ই ওঠে। গ্রাম-গঞ্জের
কাঠমোল্লা ও মাতুব্বররা
মিলে ফতোয়ার তাৎক্ষণিক আদালতে বিভিন্ন মামলার শারিয়া-মাফিক বিচার
করে রায় ঘোষণা করেন। রাষ্ট্রীয়
বৈধতা না থাকলেও সে-রায় প্রচণ্ড সামাজিক শক্তিতে অপরাধীর ওপরে প্রয়োগ
করা হয়। হিল্লা
হল এরই একধরনের
শারিয়া-মামলা যাতে কোন হিল্লা বিয়ের-কারণে শারিয়া-আদালত
কোন দম্পতির বিয়ে
বাতিল ঘোষণা করেন। তারপর
তাদের আবার বিয়ে দেবার শর্ত হিসেবে স্ত্রীকে অন্য লোকের সাথে বিয়ে ও
সহবাসে বাধ্য করেন। দ্বিতীয়
স্বামী স্বেচ্ছায়
তালাক দিলে তবে সে আবার আগের স্বামীকে বিয়ে করতে পারে।
এটা ঘটে প্রধানত স্বামী রাগের মাথায় স্ত্রীকে
একসাথে তিনবার তালাক বলে ফেলেছে বলে, তার কথা শোনার সাক্ষী কখনো থাকে, কখনো
থাকে না।
এক শ্রেণীর মূর্খ ও
বক ধার্মিক লোকেরা, শিক্ষিত
ও ব্যক্তিত্বশালী আলেমদের কাছে না গিয়ে অল্প শিক্ষিত মোল্লাদের পরামর্শে
তালাক প্রাপ্তা মহিলাকে তার আগের স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেওয়া বা হালাল
করে দেয়ার জন্য হিল্লা বিয়ের আয়োজন করে এবং এটিকে ইসলামের বিধান বলে
চালিয়ে দেয়। যার
ফলে বিতর্কিত এবং কলুষিত হচ্ছে ইসলামের সুন্দর বিধান ও
মহান আদর্শ। আর
ইসলামের শত্রুরা এটাকে তাদের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে পেয়ে
কুরআন ও ইসলামের কুৎসা রটনার ক্ষেত্রে তাদের কোন প্রচেষ্টার ত্রুটি রাখছে
না। অথচ তারা হাদিস
সম্পর্কে কোন জ্ঞানই রাখে না।
স্বামী কর্মক্ষেত্র
থেকে বাড়ীতে ফিরেছে। এসে
দেখলো এখনও রান্না শেষ হয়নি। বাস
মাথায় উঠে গেল প্রচন্ড রাগ। স্ত্রীর সাথে
শুরু করে দিল ঝগড়া। পেটে
ক্ষুধা এবং মাথায় রাগ। এক
পর্যাযে বলে ফেললো
তালাক। বাস
আর যাবে কোথায়? মসজিদের
কাঠমোল্লা দিয়ে দিল তালাকের ফতোয়া।
স্ত্রী চলে গেল বাবার বাড়ী।
কিন্তু যখন স্বামীর মাথা ঠান্ডা হলো যখন
নিজের ভুল বুঝতে পারলো। এবার
স্ত্রীকে আনার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু
বাঁধ বসালো
কাঠমোল্লা আর মাতুব্বর। স্ত্রীকে
আনতে হলে হিল্লা বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু
কাঠমোল্লারা একটু চিন্তা-ভাবনা করে না যে, যেখানে রাগ হলো স্বামীর, দোষ
করলো স্বামী এবং অপরাধী হলো স্বামী। সেখানে
স্ত্রী কেন অপরাধী হবে?
স্ত্রী কেন স্বামীর পাপের বোঝা বহন করবে?
► কুরআন কি বলে?
কিছু কাঠমোল্লারা না
বুঝলেও আল্লাহ পাক ঠিকই বোঝেন। তাই
মহান আল্লাহ পাক এরশাদ করেন-
أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ
أُخْرَى
অর্থাৎ “একে
অপরের কৃতকর্মের জন্য দায়ী হইবে না” (সূরা নজম ৩৮)।
এ কথা সবাই স্বীকার
করবেন যে, অপরাধ
হোক বা
না-হোক, সেটা
করেছে স্বামী। অথচ
হঠাৎ তালাক দিলে নিরপরাধ স্ত্রীর জীবন ধ্বংস হয়ে যায়।
সে হারায় তার স্বামী-সংসার ও সন্তান।
কিন্তু একজনের অপরাধে অন্যের শাস্তি হওয়া চরম অন্যায়।
সে জন্যই কুরআন কি চমৎকার বলেছে –
وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا
يَعْمَلُونَ
অর্থাৎ “তাহাদের
কর্ম সম্পর্কে তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে না” [সূরা বাকারা-১৪১]
তালাক এবং
তাৎক্ষণিক-দ্বিতীয় বিয়ে
(হিল্লা বিয়ে) সম্পূর্ণ কুরআন বিরোধী।
কুরআন মোতাবেক কোন নারীকে বিয়েতে বাধ্য
করার অধিকার কারো নেই। সেই
সময়ে নারীকে এ অসাধারণ অধিকার দিয়েছে কুরআন।
হিল্লা বিবাহ স্ত্রীকে দিয়ে জোরপূর্বক এক ধরণের
বেশ্যাবৃত্তি, যা সম্পূর্ণ
হারাম। এই
হারাম কাজে যারা জড়িত থাকবে হোক সে মসজিদের ইমাম, অবশ্যই সে জাহান্নামী
হবে।
► নাবী কারীম (সাঃ) কি
বলেছেন?
এবার আসুন নবী করিম (সাঃ) হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে কি বলেন।
ইসলামের ইতিহাসে হিল্লা বিবাহের কোন
ঠাই নাই। নবীজি
(সাঃ) হিল্লা বিবাহকে শুধু ঘৃনাই করতেন না, হিল্লাকারীদের
উপর লানত করতেন। জামে
আত তিরমিজী ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، قَالَ: ” لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
الْمُحِلَّ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ “.قَالَ أَبُو عِيسَى: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ.
অর্থাৎ ইবনে মাসউদ
(রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য
হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত করেছেন।*” ইমাম
তিরমিজী বলেন (র), এই হাদিসটি
হাসান সহিহ। (জামে
আত তিরমিজী, ২য়
খন্ড, হাদিস
নং ১১২০, হুসাইন
আল মাদানী
প্রকাশনী)
ইবনে মাজাহ শরীফেও
হযরত আলী (রা) হতে বর্ণিত আছে,
لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمُحِلَّ وَالْمُحَلَّلَ لَهُ
অর্থাৎ “রাসূলুল্লাহ
(সাঃ) হিল্লাকারী এবং যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে লানত ((অভিসম্পাত)
করেছেন।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২য়
খন্ড, ১৯৩৫
নং হাদিস, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন)
*
উল্লেখ্য যে, হিল্লাকারী হলো দ্বিতীয় স্বামী এবং যার
জন্য হিল্লা করা হয় সে হলো প্রথম স্বামী।
হিল্লা সম্পর্কে
সাহাবী উকবা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিস:
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ
وَسَلَّمَ: ” أَلا أُخْبِرُكُمْ بِالتَّيْسِ الْمُسْتَعَارِ؟ “، قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ
اللَّهِ، قَالَ: ” هُوَ الْمُحِللُّ “، ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَآلِهِ وَسَلَّمَ: ” لَعَنَ
اللَّهُ الْمُحِللَّ، وَالْمُحَلَّلَ لَهُ ” هَذَا حَدِيثٌ صَحِيحُ الإِسْنَادِ، وَلَمْ يُخَرِّجَاهُ،
ووافقه الذهبي.
অর্থাৎ উকবা ইবনে আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি
বলেন, “রাসূলুল্লুাহ
(সাঃ) বলেছেন আমি
কি তোমাদেরকে ভাড়া করা পাঠা সম্পর্কে বলবো? তারা
বললোঃ অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল, তিনি বললেন, হিল্লাকারী।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ হিল্লাকারী
ও যার জন্য হিল্লা করা হয় উভয়কে অভিসম্পাত করেছেন।
” [সুনানে ইবনে
মাজাহ, ২য়
খন্ড, ১৯৩৬
নং হাদিস, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন]
হাদিস দুটিতে লক্ষ্য
করুন। প্রথম হাদিসে স্বামী
এবং হিল্লাকারী পুরুষকে লানত করা হয়েছে। অর্থাৎ
অভিশাপ দেওয়া হয়েছে, তারা
আল্লাহর রহমত হতে
বঞ্চিত। দ্বিতীয়
হাদিসে হিল্লাকারী পুরুষকে ভাড়া করা পাঠার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
কোন ব্যক্তি যদি বলে আমি অমুকের স্ত্রীকে
হিল্লা বিয়ে করে আবার তালাক দিব যাতে সে তার স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ
করতে পারে। হাদিস
অনুযায়ী সে ব্যক্তি হলো ভাড়া করা পাঠা। আর
এ পাঠার
দলে যারা থাকে তারাও পাঠার দল। অতএব
যে সমস্ত কাঠমোল্লা বা মাতুব্বর হিল্লাকে বৈধ মনে করবে তারাও পাঠা।
আমার জানা মতে এই পাঠাকে একমাত্র কালি পূজায়
বলি দেওয়া হয়। দেখুন
হযরত উমর (রা) কি বলেন।
“হযরত
আসরাম (র) কাবিসাবিল জাবের (রা) হতে বর্ণনা করেন, একদিন
হযরত উমর (রা) তাঁর খেলাফতকালে মসজিদের মিম্বরে উঠে বললেন, আমার
নিকট যদি এমন মামলা আসে যাতে হিল্লাকারী (২য় স্বামী) এবং যার জন্য
হিল্লা করা হয় (১ম স্বামী) এমন কাউকে আনা হয়, আমি দুজনকেই পাথর মেরে হত্যা
করবো।”
যারা পাপ করে তারা পাপী এবং যারা সেই পাপের সহযোগিতা করে তারাও
পাপী। অতএব সাবধান যারা
হিল্লা বিবাহকে সহযোগিতা করবে তারাও পাপের অংশীদার।
► যেভাবে শুরু হলো
হিল্লা বিয়ের প্রথা:
এখন আসি কিভাবে
হিল্লা বিয়ের প্রথা শুরু হলো।
নবী (সাঃ) এর ওফাতের পর মানুষ ধীরে ধীরে ধর্ম থেকে দূরে
সরে আসার কারণে
এই মুসলিম সমাজে তালাকের প্রবণতা বেড়ে যায়।
ফলে এর সমাধানের জন্য এক
শ্রেণীর মোল্লাদের দ্বারা হিল্লা বিয়ের মত কু-প্রথা সমাজে চালু হয়ে পড়ে।
আর এর জন্য নিন্মের কুরআনের আয়াতকে অপব্যবহার করা হয়।
মূলত যে সমস্ত আলেম বা কাঠমোল্লা হিল্লা বিয়ে
জায়েজ করতে চায় তারা কুরআন-হাদিস সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অপব্যাখ্যা করে।
আর তারা তাদের স্বার্থে সূরা বাকারার ২৩০
নং আয়াতকে দলিল হিসাবে তুলে ধরে।
فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا
فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ
وَتِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ يُبَيِّنُهَا لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
অর্থাৎ “তারপর
যদি সে স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে সে স্ত্রী যে পর্যন্ত তাকে ছাড়া অপর
কোন স্বামীর সাথে বিয়ে করে না নেবে, তার জন্য হালাল নয়।
অতঃপর যদি দ্বিতীয় স্বামী তালাক দিয়ে দেয়, তাহলে
তাদের উভয়ের জন্যই পরষ্পরকে পুনরায় বিয়ে করাতে কোন পাপ নেই, যদি
আল্লাহ হুকুম বজায় রাখার ইচ্ছা থাকে।
আর এই হলো আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা; যারা
উপলব্ধি করে তাদের
জন্য এসব বর্ণনা করা হয়।” [সূরা
বাকারা-২৩০]
• প্রকৃত বিশ্লেষণ •
কাঠামোল্লারা উপরের
আয়াতের দোহাই দিয়ে হিল্লা বিবাহ জায়েজ করতে চায়।
কিন্তু তারা গবেষণা করে না যে এই আয়াতটি কাদের
জন্য প্রযোজ্য। তারা
এটাও লক্ষ্য করে না যে,
পরবর্তী ২৩২ নং আয়াতে আল্লাহ
কি বলেছেন। এবার
সূরা বাবাকার ২৩২ নং আয়াত লক্ষ্য করি। মহান
আল্লাহ এরশাদ
করেন-
وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاءَ فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلَا تَعْضُلُوهُنَّ أَنْ يَنْكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ
إِذَا تَرَاضَوْا بَيْنَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ ذَلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَنْ كَانَ مِنْكُمْ يُؤْمِنُ
بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكُمْ أَزْكَى لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
অর্থাৎ “তোমরা
যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এবং তারা তাদের ইদ্দতকাল পূর্ণ করে তবে স্ত্রীগণ
নিজেদের স্বামীদেরকে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিয়ে করতে চাইলে তাদের
বাঁধা দিও না। এ
উপদেশ তাকেই দেয়া হচ্ছে,
যে আল্লাহ ও কেয়ামত দিনের
ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। এর
মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে একান্ত পরিশুদ্ধতা ও অনেক পবিত্রতা।
আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।” [সুরা বাকারা-২৩২]
উল্লেখিত আয়াতে দেখা
যাচ্ছে যে, স্ত্রীকে তালাক
দেওয়ার পর যদি নির্ধারিত ইদ্দত শেষও হয়ে যায়, তখন স্বামীর সাথে পারস্পারিক
সম্মতিক্রমে বিয়ে করা যাবে। এখানে
মনে হতে পারে যে, সূরা বাকারার
২৩০নং আয়াত ২৩২ নং আয়াতের সাথে বিরোধপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
উক্ত দুটি আয়াত ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে বিরোধপুর্ণ নয়।
এ দুটি আয়াত বোঝার জন্য এখন হাদিস শরীফ অনুসন্ধন
করতে হবে। দেখতে
হবে নবীজি (সাঃ) কি করেছেন।
তার আগে আমি সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতে শানে নুজুল উল্লেখ
করতে চাই।
অর্থাৎ কোন প্রেক্ষাপটে সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াত নাজিল
হযেছে। তাফসীরে
ইবনে কাসীর-এ সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াতের শানে নুজুল সম্পর্কে উল্লেখ
আছে-
“আয়াতটি
হযরত মা’কাল
বিন ইয়াসার (রা)
এবং তাঁর বোনের সম্বন্ধে অবর্তীর্ণ হয়।
হযরত মা’কাল বিন ইয়াসার (রা) বলেন, ‘আমার
নিকট আমার বোনের বিয়ের প্রস্তাব আসলে আমি তার বিয়ে দেই।
তার স্বামী কিছুদিন পর তাকে তালাক দেয়।
ইদ্দত অতিক্রান্ত হওয়ার পর পুনরায় সে আমার
নিকট বিয়ের প্রস্তাব করে। আমি
তা প্রত্যাখ্যান করি। আমি
শপথ করি যে, তার
সাথে আমার বোনে বিবাহ দিব না। তখন
এই আয়াতটি (সূরা বাকারার ২৩২ নং আয়াত) অবতীর্ণ হয়।
এটা শুনে হযরত মা’কাল (রা) বলেন, শপথ
করা সত্বেও আমি
আল্লাহর নির্দেশ শুনেছি এবং মেনে নিয়েছি।
অতঃপর তিনি তাঁর বোনকে ডেকে পাঠিয়ে
পুনরায় তার সাথে তাঁর বোনের বিয়ে দিয়ে দেন এবং নিজের কসমের কাফ্ফারা
আদায় করেন। তাঁর
বোনের নাম ছিল জামীল বিনতে ইয়াসার (রা) এবং তাঁর
স্বামীর নাম ছিল আবুল বাদাহ (রা)।”
আয়াতের শানে নুজুলে
দেখা যাচ্ছে কোন
হিল্লা বিয়ে ছাড়াই হযরত মা’কাল
বিন ইয়াসার (রা) তার বোনকে পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহ দিলেন।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত বুখারী শরীফ ৭ম
খন্ড, ৪১৭৩
নং হাদিসেও উক্ত ঘটনা বর্ণিত আছে। তাই
জোর দিয়ে বলা যায় সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াত দিয়ে হিল্লা
বিবাহের যে অপব্যাখ্যা দেয়া হয় তা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা ভিন্ন হবে যা, পরে
আলোচনা করছি। আসলে
ঐ সব মোল্লারা এই আয়াতের শানে নজুল জানে না বা নিজেদের
স্বার্থ রক্ষার জন্য এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে থাকে।
এবার আমি ২৩২ নং আয়াতের স্বপক্ষে কিছু হাদিস শরীফ
পেশ করছি।
*আবু
দাউদ শরীফের কিতাবুত তালাক অধ্যায়ে ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত*
তিনি বলেন, রুকানার
পিতা আবদ ইয়াযীদ উম্মে রুকানাকে তালাক প্রদান করেন এবং যুযায়না গোত্রের
জনৈক স্ত্রীলোককে বিবাহ করেন। সেই
মহিলা নবী করীম (সা) এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে বলে, সে
সহবাসে অক্ষম, যেমন
আমার মাথার চুল অন্য চুলের কোন উপকারে আসে না।
কাজেই আপনি তার ও আমার মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিন।
এতশ্রবণে নবী করীম (সা) রাগান্বিত হন এবং তিনি
রুকানা ও তার ভাইদিগকে আহবান করেন। এরপর
তিনি সেখানে উপস্থিত করে সাথীদের সম্বোধন করে বলেন, তোমারা লক্ষ্য করে দেখ
যে, এদের
মধ্যে অমুক অমুকের বিশেষ অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তাদের পিতা আবদ ইয়াযীদের
অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে কি মিল খাচ্ছে না? তখন তারা বলেন, হ্যাঁ। নবী
করীম (সাঃ) আবদ ইয়াযীদকে বলেন, তুমি তাকে তালাক দিয়ে দাও।
তিনি তাকে তালাক দিলেন।
এরপর তিনি তাকে নির্দেশ দেন যে, তুমি
উম্মে রুকানাকে (পূর্ব স্ত্রী) পুনরায় গ্রহণ কর।
তখন তিনি বলেন, আমি তো তাকে তিন তালাক প্রদান করেছি, ইয়া
রাসূল্লাহ! তখন তিনি বলেন,
আমি তোমার তালাক প্রদানের কথা অবগত আছি।
তুমি তাকে পুনরায় গ্রহণ কর।
এরপর তিনি কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করেন, ‘হে
নবী! যখন তোমাদের স্ত্রীদের তালাক প্রদান করবে, তখন তাদেরকে ইদ্দত পালনের
জন্য তালাক দিবে।”ইমাম আবু দাউদ (র) বলেন, আবদ
ইয়াযীদ তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে নবী করিম (সা) তাকে
পুনরায় গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।
[আবু দাউদ শরীফ, ৩য় খন্ড, ২১৯৩নং হাদিস, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন]
উক্ত হাদিস শরীফে
দেখা যাচ্ছে যে, উম্মে রুকানাকে
নবী করীম (সাঃ)হিল্লা বিবাহ ছাড়াই তার স্বামী আবদ ইয়াযীদ এর সাথে
পুনরায় বিবাহ দিলেন। অতএব
নবীজি হিল্লা বিবাহকে হারাম জানতেন তা প্রমানিত হলো।
**
ইবনে আব্বাস (রা) ও উমার (রা) হতে বর্ণিত **
‘নবী
করীম (সাঃ)
হযরত হাফসা (রা) কে তালাক প্রদান করেন। এরপর
তিনি তাঁকে পুনরায় স্বীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।” [আবু
দাউদ শরীফ, ৩য়
খন্ড, ২২৭৭
নং হাদিস
এবং সুনানে নাসাই শরীফ,
৩য় খন্ড, ৩৫৬১নং হাদিস, ইসলামিক
ফাউন্ডেশন]
এ হাদিসেও হিল্লা
বিবাহের কোন অস্তিত্ব নেই।
হিল্লা বিবাহ ছাড়াই নবীজি (সাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ) কে
পুনরায় বিবাহ করলেন।
তাই হিল্লা বিবাহ অবৈধ, ইহাতে কোন সন্দেহ নেই।
যেহেতু সূরা বাকারার ২৩২
নং আয়াত সম্পর্কে হাদিস শরীফে প্রমান পাওয়া যায় যে, হিল্লা
বিয়ে ছাড়াই
তালাকের পর পুনরায় স্ত্রীকে গ্রহণ করা যায়, সেহেতু ২৩০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
ভুল। সূরা বাকারার ২৩০ নং
আয়াত ঐ সমস্ত নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যারা
তালাক প্রাপ্ত হয়ে যাবার পর স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ
করে এবং পরবর্তীতে আবার পুর্বের স্বামীর নিকট ফিরে যেতে চায়।
► শেষ কথা
উল্লেখিত হাদিসসমূহ
হতে আমরা সূরা বাকারার ২৩০ নং আয়াতে ব্যাখ্যা বুঝতে পারলাম।
অর্থাৎ প্রথম স্বামী স্ত্রীকে তালাক দিলে
ঐ স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় দ্বিতীয় বিবাহ করে, তবে ঐ স্ত্রী পূর্বের স্বামীর
নিকট ফিরে যেতে পারবে না,
যতক্ষন না দ্বিতীয় স্বামী স্বেচ্ছায় ঐ স্ত্রীকে
তালাক না দেয়।
আর সূরা বাকারার ২৩২
নং আয়াতের ব্যাখ্যা হলো, যদি স্ত্রী প্রথম স্বামীর নিকট হতে
তালাক প্রাপ্ত হওয়ার অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়, তবে
সে পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে উভয়ের সম্মতিতে।
এতে কোন ধমীয় বা আইনি বাঁধা থাকবে না। হিল্লা
বিয়ে নামে যা প্রচলিত আছে,
তা হারাম এবং অনৈসলামিক কর্মকান্ড।
তাই সূরা বাকারার ২৩০ ও ২৩২ নং আয়াত দুটি
ব্যাখ্যাগত দিক দিয়ে অনুরসণ যোগ্য।
আমাদের দেশে সেই
পাকিস্তানী আমল থেকে ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ
দ্বারা তালাকে বিদা নিষিদ্ধ এবং হিল্লা বিয়ের প্রথা নিষিদ্ধ করা হয়।
আশা করি বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশেও
এই আইন কার্যকর হবে এবং হিল্লা বিয়ের মত অনৈসলামিক প্রথা চিরতরে ইসলামী
সমাজ থেকে বন্ধ করা যাবে। এ
ব্যাপারে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে যেন ধর্মের নামে হিল্লা বিয়ে দিয়ে কোন
মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা না হয়।
যদি কোথাও এরকম কোন দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখা দেয় তবে সেই বিপদের
হাত থেকে অসহায় নারীকে উদ্ধার করা ওয়াজিব। জেনে
শুনে যারা অসহায়কে
সাহায্য করে না তাদের উপর আল্লাহর রহমত আসে না।
এ ব্যাপারে কারো সহযোগিতা না পেলে
সরাসরি স্থানীয় প্রশাসন,
থানা অথবা গণমাধ্যমকর্মীর সাহায্য
নিন। একজন অসহায় নারীকে
বিপদ হতে উদ্ধারের জন্য আল্লাহ পাক আপনাকে বড় ধরণের কোন
পুরস্কার দিবেন। আল্লাহ
আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন এবং হিল্লা বিবাহে প্রতিরোধ গড়ে
তোলার তাওফিক দিন। আমিন
1 comment:
jkbkjn
Post a Comment