• আমাদের দাওয়াত : সকল বিধান বাতিল কর, অহি-র বিধান কায়েম কর। আসুন! পবিত্র কুর‘আন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি।

10 November, 2016

ইসলাম ও জঙ্গীবাদ

কখনো তালেবান, কখনো আল-কায়েদা, কখনো জেএমবি, কখনো আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, কখনো আইএস; এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নামে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে, যাদেরকে আমরা জঙ্গী গোষ্ঠী বলে জানিসময়ের ব্যবধানে এক পর্যায়ে এদের সাময়িক পতনও হয়কিন্তু মাঝখান দিয়ে প্রাণ হারায় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষগুরুতর আহত ও পঙ্গু হয় অনেকেইধ্বংস হয় বহু স্থাপনাশুধু তাই নয়, প্রতিবারই সারা বিশ্বে মুসলমানদের দেখানো হয় একটা সন্ত্রাসী জাতি হিসাবেআর এভাবেই একদল বিপথগামী চরমপন্থীদের কারণে ইসলাম, মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হচ্ছেঅবস্থা এখন এমন যে, জঙ্গীবাদ শব্দটি শুনলেই চোখের সামনে মুসলমানদের চেহারা ভেসে ওঠেঅথচ জঙ্গীবাদের সাথে ইসলামের দূরতম কোন সম্পর্ক নেই
কুরআন ও হাদীছের আলোকে জঙ্গীবাদ একটি ভ্রান্তপথের নামপবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন,وَقَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَلَا تَعْتَدُوْا إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ- তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর (তাদের বিরুদ্ধে) যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করছেকিন্তু সীমালঙ্ঘন কর নানিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পসন্দ করেন না (বাকবারাহ ২/১৯০)
এই আয়াতের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় মহানবী (ছাঃ)-এর একটি হাদীছ থেকেবুরাইদাহ (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) যখন কোন সৈন্যদলকে প্রেরণ করতেন তখন বলতেন,اغْزُوْا بِاسْمِ اللهِ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ قَاتِلُوْا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوْا وَلاَ تَغُلُّوْا وَلاَ تَغْدِرُوْا وَلاَ تَمْثُلُوْا وَلاَ تَقْتُلُوْا وَلِيْدًا- তোমরা আল্লাহর নামে তাঁর রাস্তায় যুদ্ধ করযুদ্ধ কর কিন্তু গণীমতের মাল খেয়ানত কর নাচুক্তি ভঙ্গ কর নাশত্রুর অঙ্গহানি কর নাশিশুদের হত্যা কর না।[1]
উক্ত আয়াত ও হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, প্রথমতঃ যুদ্ধ করতে হবে তাদের বিরুদ্ধে যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্তকিন্তু বর্তমানে সিংহভাগ আক্রমণই হল সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধেসুতরাং তাদের এহেন কর্ম ইসলাম সম্মত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না

দ্বিতীয়তঃ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে তাদের সাথে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছেন, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেআর হাদীছটির প্রথম বাক্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, সেই যুদ্ধটা হতে হবে কোন শাসকের অধীনেকিন্তু বর্তমান সময়ে চরমপন্থী জঙ্গীরা ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে যেসব যুদ্ধ করছে তা তাদের দেশের শাসকের অধীনে তো নয়ই বরং শাসকের বিরুদ্ধে এরা যুদ্ধ করছে
তৃতীয়তঃ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা যুদ্ধের সময়ে সীমালঙ্ঘন করতে নিষেধ করেছেনআর হাদীছ থেকে জানা যায় যে, সীমালঙ্ঘনের মধ্যে রয়েছে শিশুদের হত্যা করা এবং উপাসনাকারীদের হত্যা করাকিন্তু জঙ্গীরা অহরহ আত্মঘাতী বোমা হামলাসহ বিভিন্নভাবে অসংখ্য শিশু হত্যা করে চলেছে যা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়এছাড়াও তারা অনেক সময় বিভিন্ন উপাসনালয়ে (যেমন বিভিন্ন গীর্জা, মসজিদ ইত্যাদি) হামলা চালিয়ে উপাসনারত মুসলিম, অমুসলিমদের হত্যা করছে, যাকে সীমালঙ্ঘন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে কুরআন ও হাদীছে
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,مَنْ قَتَلَ نَفْسًا بِغَيْرِ نَفْسٍ أَوْ فَسَادٍ فِي الْأَرْضِ فَكَأَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيعًا-  যে ব্যক্তি মানুষ হত্যা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টির কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকেই হত্যা করল (মায়েদাহ ৫/৩২)
এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, উক্ত দুটি বিশেষ কারণ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করারই শামিলকিন্তু জঙ্গীরা নিরপরাধ সাধারণ মুসলিম, অমুসলিমদের তাদের অস্ত্রের লক্ষ্যবস্ত্ত বানাচ্ছে যেটা কখনোই ইসলাম সম্মত হতে পারে না
ইসলামে যুদ্ধের সময়েও নারী-শিশু হত্যাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছেইবনে ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর এক যুদ্ধে একজন নিহত মহিলাকে পাওয়া যায়। (এটা দেখে) তখন মহানবী (ছাঃ) তা অপসন্দ করেন।[2] অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধাবস্থাতেও নারী ও শিশু হত্যাকে নিষেধ করেছেন।[3] কিন্তু জঙ্গীরা যুদ্ধের সময় তো নয়ই বরং স্বাভাবিক অবস্থাতেও বিভিন্ন স্থানে বোমা মেরে অগণিত নারী-শিশু হত্যা করে চলেছে
আল্লাহ তাআলা বলেন,وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلَّهِ তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না ফিৎনা দূরীভূত হয় এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্ল­াহর জন্যে হয়ে যায় (বাক্বারাহ ২/১৯৩; আনফাল ৮/৩৯)ইবনে ওমর (রাঃ) এই হাদীছের ব্যাখ্যায় এক ব্যক্তির প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তুমি কি জান ফিৎনা কী? নবী করীম (ছাঃ) যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধেতাদের উপরে আরোপিত হওয়াটাই ছিল ফিৎনাতোমাদের মত যুদ্ধ নয়, যা হচ্ছে শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য।[4]
আলোচ্য আয়াত ও হাদীছ থেকে বুঝা যায়, ইবনে ওমর (রাঃ)-এর কাছে প্রশ্নকারী ব্যক্তি শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ করাকে জায়েয মনে করতআর ইবনে ওমর (রাঃ) সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেনবর্তমানে জঙ্গীদের সকল যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল উদ্দেশ্য হল ঐ শাসন ক্ষমতা লাভ, যা ইসলাম সমর্থন করে না
আরেকটি হাদীছে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী ইবনু আবূ তালিব (রাঃ) ইয়ামান থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে সিলম বৃক্ষের পাতা দ্বারা পরিশোধিত এক প্রকার (রঙিন) চামড়ার থলেতে করে সামান্য কিছু তাজা স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেনতখনও এগুলো থেকে সংযুক্ত খনিজ মাটি পরিষ্কার করা হয়নিআবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) চার ব্যক্তির মধ্যে স্বর্ণখন্ডটি বণ্টন করে দিলেনতারা হলেন, উয়ায়না ইবনু বাদর, আকরা ইবনু হাবিস, যায়েদ আল-খায়ল এবং চতুর্থজন আলকামা কিংবা আমির ইবনু তুফাইল (রাঃ)তখন ছাহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন, এ স্বর্ণের ব্যাপারে তাঁদের অপেক্ষা আমরাই অধিক হকদার ছিলামরাবী বলেন, কথাটি রাসূল (ছাঃ) পর্যন্ত পৌঁছলতাই রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না? অথচ আমি আসমানের অধিবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে? এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াললোকটির চোখ দুটি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপালধারী, তার দাড়ি ছিল অতিশয় ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরনের লুঙ্গি ছিল উপরের দিক উঠানসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আল্লাহকে ভয় করুনরাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহকে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি বেশি হকদার নই? আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, লোকটি (এ কথা বলে) চলে যেতে লাগলে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ (ছাঃ)! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, না, তে পারে সে ছালাত আদায় করে (বাহ্যত মুসলমান)খালিদ (রাঃ) বললেন, অনেক ছালাত আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন এমন কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে নেইরাসূল (ছাঃ) বললেন, আমাকে মানুষের দিল ছিদ্র করে, পেট ফেঁড়ে (ঈমানের উপস্থিতি) দেখার জন্য বলা হয়নিতারপর তিনি লোকটির দিকে তাকিয়ে দেখলেনতখন লোকটি পিঠ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছেরাসূল (ছাঃ) বললেন, এ ব্যক্তির বংশ থেকে এমন এক জাতির উদ্ভব ঘটবে যারা শ্রুতিমধুর কন্ঠে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করবে অথচ আল্লাহর বাণী তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে নাতারা দ্বীন থেকে এমনভাবে বেরিয়ে যাবে যেভাবে নিক্ষেপকৃত জন্তুর দেহ ভেদ করে তীর বেরিয়ে যায়। (বর্ণনাকারী বলেন,) আমার মনে হয় রাসূল (ছাঃ) এ কথাও বলেছেন, যদি আমি তাদেরকে পাই, তাহলে অবশ্যই ছামূদ জাতির মতো হত্যা করব।[5]
হাদীছটিতে দেখা যাচ্ছে, ঐ ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলেছেন, আল্লাহকে ভয় করুনপরোক্ষভাবে ঐ ব্যক্তি এ কথাই বলেছে যে, আপনি এখন আল্লাহকে ভয় করছেন নাএটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শানে জঘন্য বেয়াদবীলোকটি এ কথা বলতে পেরেছিল এ কারণে যে, সে শুধু নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়েই নবী করীম (ছাঃ)-এর কাজকে বিচার করেছিলসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছ থেকে কোন ব্যাখ্যা চায়নিএভাবেই সে নিজেকে সঠিক আর রাসূল (ছাঃ)-কে বেঠিক বলার মত দুঃসাহস দেখিয়েছিল
হাদীছটিতে নবী করীম (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, পরবর্তীতে এ ধরনের লোকের আবির্ভাব ঘটবে যাদেরকে তিনি নিজে ছামূদ জাতির মত হত্যা করতে চেয়েছেন
এবার আসুন আমরা চরমপন্থী জঙ্গীদের দিকে একটু তাকাইএরা কেবল নিজেদেরকেই সঠিক আর তাদের বিরোধীদের বেঠিক মনে করেশুধু তাই নয়, এরা এদের বিরোধীদের কাফের, মুরতাদ ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে হত্যা করছেএদের কাজ হাদীছের ঐ লোকটির সাথে মিলে যায়সুতরাং আমরা কোন সন্দেহ ছাড়াই বলতে পারি যে, বর্তমান জঙ্গী গোষ্ঠীই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীর সেই অভিশপ্ত দল
অন্য হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الإِيْمَانِ- তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন অন্যায় দেখতে পায়, সে যেন হাত দ্বারা তা প্রতিরোধ করেযদি এটা সম্ভব না হয়, তাহলে সে যেন মুখ দিয়ে (সেটা প্রতিরোধ করে)আর যদি তাও সম্ভব না হয়, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে (সেটা ঘৃণা করে)আর এটাই হল ঈমানের সর্বনিম্ন পর্যায়।[6]
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে জঙ্গীবাদের মাধ্যমে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করাতাই মুসলিম হিসাবে আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাআল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক দান করুন-আমীন!
[1]. মুসলিম হা/১৭৩১, মিশকাত হা/৩৯২৯
[2]. বুখারী হা/৩০১৪; মুসলিম হা/১৭৪৪
[3]. বুখারী হা/৩০১৫
[4]. বুখারী হা/৪৬৫১, ৭০৯৫
[5]. বুখারী হা/৪০১৩, ৩৩৪৪, ৫০৫৮

[6]. মুসলিম হা/৮৩; মিশকাত হা/৫১৩৭

No comments: